
এম. নাছির উদ্দীন, কলাপাড়া
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হলো ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। তারুণ্যের উৎসব ২০২৫ উপলক্ষে “এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আয়োজিত এই মেগা ইভেন্টে অংশ নেয় উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন পরিষদ। হাজারো দর্শকের উপস্থিতিতে আন্দারমানিক নদী পরিণত হয় উৎসবের মিলনমেলায়।
ঐতিহ্যের ঢেউ তুলল “তারুণ্যের নৌকাবাইচ”
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার দুপুর ২টায় কলাপাড়া হেলিপ্যাড মাঠ সংলগ্ন আন্দারমানিক নদীতে আয়োজিত হয় এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ রবিউল ইসলামের আমন্ত্রণে ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত এই ইভেন্টে প্রতিযোগিতার মূল আকর্ষণ ছিল গ্রাম বাংলার বিশাল আকৃতির ঐতিহ্যবাহী নৌকা।
প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) জনাব মোঃ রায়হান কাওছার। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, “বাংলার ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতেই এই আয়োজন, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।”
বিশিষ্ট অতিথিরা ও জনতার ঢল
প্রতিযোগিতায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদ আলম, পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মোঃ আনোয়ার জাহিদ, এবং জেলা প্রশাসক মোঃ আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন। আয়োজনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিবর্গ।
নদীর দুই পাড়, শেখ কামাল সেতু এবং আশপাশের এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। হাজারো মানুষ গলা ফাটিয়ে উৎসাহ দেয় প্রতিযোগীদের। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরাও এই ঐতিহাসিক আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন।
বিজয়ীদের জয়োৎসব
দুইটি ইভেন্টে অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় ১২টি ইউনিয়ন অংশ নেয়। প্রতিযোগিতার প্রথম স্থান অর্জন করে লতাচাপলী ইউনিয়ন, দ্বিতীয় হয় ধানখালী ইউনিয়ন এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করে মিঠাগঞ্জ ইউনিয়ন। বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন জেলা প্রশাসক মোঃ আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন।
৩৫ বছর পর আবার নবজাগরণ
এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা কলাপাড়ায় ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হলো, যা মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ রবিউল ইসলাম বলেন, “এই আয়োজন আমাদের ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। ভবিষ্যতে এটি আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হবে।”
গঙ্গা-পদ্মার বুকে জন্ম নেওয়া নৌকাগুলো
এই প্রতিযোগিতার জন্য গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর থেকে আনা হয় ১২টি বিশাল নৌকা। প্রতিটি নৌকার দৈর্ঘ্য ১৩০ ফুট এবং প্রস্থ ৫২ ইঞ্চি। প্রতিটি নৌকায় ৬০-৮০ জন মাঝি-মাল্লা বৈঠা চালায়।
গোপালগঞ্জ কোটালীপাড়ার এক নৌকার মালিক রঞ্জিত বালা বলেন, “এটি আমাদের পৈতৃক পেশা। বর্ষা মৌসুমেই মূলত নৌকা বাইচ হয়, তবে এমন বড় আয়োজনে অংশ নিতে পেরে আমরা আনন্দিত।”
অপর নৌকার মালিক লাজারেজ ফলিয়া জানান, “আমাদের নৌকা পাঁচ-ছয় দিন আগেই রওয়ানা দেয়। মাদারীপুর থেকে আসতে চারদিন লেগেছে।”
নিরাপত্তায় কঠোর নজরদারি
উৎসবমুখর এই আয়োজনে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। ফায়ার সার্ভিস, নৌ পুলিশ, মেডিকেল টিম এবং প্রশাসনের বিশেষ নজরদারিতে প্রতিযোগিতা সম্পন্ন হয়।
নৌকাবাইচের উন্মাদনা আগামীতে আরও বিস্তৃত হবে
এই ঐতিহাসিক আয়োজন শুধু বিনোদনের জন্য নয়, বরং এটি বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস। আয়োজকরা আশা প্রকাশ করেন, প্রতি বছর আরও বৃহৎ পরিসরে এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে।