রাখাইনদের ‘সাংগ্রাই’ জলকেলি উৎসবে রঙিন কুয়াকাটা, ঐতিহ্যে ভাসছে কেরানীপাড়া

এম. নাছির উদ্দীনঃ রাখাইন বর্ষবরণ উপলক্ষে কুয়াকাটায় শুরু হয়েছে রাখাইন সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব ‘সাংগ্রাই’। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বিকেল ৩টায় কুয়াকাটা কেরানীপাড়া রাখাইন মার্কেট মাঠে এই উৎসবের সূচনা হয়। পুরোনো বছর ১৩৮৬ কে বিদায় এবং নতুন বছর ১৩৮৭ কে বরণের আনন্দে রাখাইন তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ উৎসবে অংশ নেন।

নৃত্যের ছন্দ, ঐতিহ্যবাহী সংগীত পরিবেশনা ও আন্তরিক জলকেলিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো কুয়াকাটা এলাকা। রাখাইন তরুণীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে অংশ নেন নৃত্য পরিবেশনায়। এরপর পানি ছিটিয়ে একে অপরকে শুদ্ধ করে তোলেন, যা এই উৎসবের মূল আচার হিসেবে বিবেচিত। রাখাইন ভাষায় এ উৎসবের নাম ‘সাংগ্রাই’, যার মূলে রয়েছে আত্মশুদ্ধি, পুরনো দুঃখ-গ্লানি ধুয়ে নতুন বছরের সূচনা।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এমং তালুকদার। প্রধান অতিথি ছিলেন কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ রবিউল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কুয়াকাটা টুরিস্ট পুলিশ জোনের সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ হাবিবুর রহমান, মহিপুর থানার (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম, কুয়াকাটা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন আমির, কুয়াকাটা খানাবাদ ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ড. শহিদুল ইসলাম শাহীন এবং কুয়াকাটা পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমানসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইউএনও মোঃ রবিউল ইসলাম বলেন, “জলকেলি উৎসবটি রাখাইনদের হলেও এটি এখন কুয়াকাটা তথা দক্ষিণ উপকূলের অন্যতম বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক সম্পদে পরিণত হয়েছে। এই উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাঠে কাজ করছেন এবং প্যান্ডেল ও উৎসবস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।”

রাখাইন তরুণী ইয়াংসা বলেন, “এই উৎসব শুধু আনন্দ নয়, আমাদের ঐতিহ্য। পুরনো গ্লানি ধুয়ে নতুন বছরে শুদ্ধ মন নিয়ে প্রবেশ করার উৎসব এটি। ৩ দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে আমরা রান্না করি আমাদের ঐতিহ্যবাহী খাবার, যেমন—ওনো-নো খাউই, মো হিন গা ইত্যাদি।”

ঐতিহাসিকভাবে ‘সাংগ্রাই’ রাখাইনদের থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এক বর্ষবরণ উৎসব। এটি কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক বন্ধন, সংস্কৃতি ও পারস্পরিক ভালোবাসার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। কুয়াকাটার রাখাইন পল্লিগুলোতে এ উৎসব শত বছরের বেশি সময় ধরে পালিত হয়ে আসছে।

এই উৎসবকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যটনেও এসেছে নতুন মাত্রা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে উৎসুক পর্যটকেরা এসেছেন রাখাইনদের জলকেলি দেখতে। ঢাকার আগত পর্যটক রাকিবুল হাসান বলেন, “সমুদ্র সৈকতের পাশেই এত সুন্দর ও বর্ণাঢ্য এক সাংস্কৃতিক উৎসব দেখার অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই যে আনন্দে মেতে আছে, সেটা হৃদয় ছুঁয়ে যায়।”

স্থানীয় দোকানদার হ্লা থুই বলেন, “এই উৎসব ঘিরে আমাদের ব্যবসা ভালো হয়। হস্তশিল্প, রাখাইন খাবার, পোশাক সব কিছুতেই বিক্রি বাড়ে। সরকারের সহযোগিতা থাকলে এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উৎসবে রূপ দেওয়া সম্ভব।”

উৎসবে রাখাইন শিশু-কিশোররাও অংশ নেয় নাচ, গান ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায়। মঞ্চে বাজে ঐতিহ্যবাহী রাখাইন বাদ্যযন্ত্র, পরিবেশিত হয় লোকসংগীত ও ধর্মীয় গান। বাড়ি বাড়ি রান্না হয় রাখাইনদের নিজস্ব সুস্বাদু খাবার।

উল্লেখ্য, এই উৎসব আগামী দুই দিন পর্যন্ত চলবে, প্রতিদিনই থাকবে নানা ধরনের অনুষ্ঠান ও আনন্দ আয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *